প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(শেষ পর্ব) - সিরাজুর রহমান
প্রতিশোধস্পৃহার
রাজনীতি(শেষ পর্ব) - সিরাজুর
রহমান
প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(শেষ পর্ব) - সিরাজুর রহমান |
প্রতিশোধস্পৃহার
রাজনীতি - শেষ পর্ব ( The Political Revenge_Last Part )
লেখক : সিরাজুর
রহমান, প্রয়াত সাংবাদিক, বিবিসি
বাংলা বিভাগ
শেষ পর্ব - সম্ভাবনার অঙ্কুরেই
বিনাশ
আসলে কী বলেছিলেন শেখ
হাসিনা সে রাতে টেলিভাষণে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য
প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা দেখা
দিয়েছিল, সে সম্ভাবনাই সেদিন
নস্যাৎ হয়ে যায়।
এর পুনরাবৃত্তি আরো অনেকবার ঘটেছে। এখন
আমরা জানি, ২০০৮ সালের
ডিসেম্বরের নির্বাচনটা ছিল একটা দেশী-বিদেশী-সামরিক-মিডিয়া
আঁতাতের ফসল। যা-ই হোক, সে
নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিরাট
জয় পেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু
তাতে তার নিজের কিংবা
দেশের কী লাভ হলো?
সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বেগম
জিয়া ও জিয়াপরিবারের বিরুদ্ধে
গালিগালাজের কোনো প্রয়োজন ছিল
কি? তাতে ব্যক্তি, রাজনীতিক,
এমনকি মুজিবকন্যা হিসেবেও তার সামান্যতম মর্যাদা
বৃদ্ধি ঘটেছে কি? এর
বদলে তখন থেকেই যদি
তিনি সুশাসন ও জাতীয়
ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিতেন
তাহলে এত দিনে জাতীয়
পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে
যেতে পারত, জাতি সম্ভবত
ভোট দিয়েই তাকে প্রধানমন্ত্রী
করে রাখতে চাইত।
কিন্তু সেটা কি তাদের
কাম্য ছিল? আমার সন্দেহ
হয়। প্রায়ই
মনে হয়- ক্ষমতা, দেশ
শাসন, এমনকি রাজনীতিক হিসেবে
দেশের ও বিশ্বের সম্মান
ও মর্যাদা আওয়ামী লীগের কাম্য
নয়।
এরশাদের
সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়ে সেই
যে শুরু করেছিলেন, সেই
যে ভূতটাকে তিনি বোতল থেকে
বের করে দিয়েছিলেন, তার
হাত থেকে পরিত্রাণের কোনো
উপায় আজো তিনি খুঁজে
পাননি। তার
দল ও সরকারের কাজের
মধ্যেই কোথায় যেন জাতিকে
শাস্তি দেয়ার, প্রতিশোধ নেয়ার
একটা বাসনা প্রচ্ছন্ন থাকে।
ভাগ্যহত
বাংলাদেশও মাঝে মাঝে সৌভাগ্যের
মুখোমুখি হয়েছিল। একটা
বঞ্চিত ও নির্যাতিত জাতি
সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে,
শত প্রতিকূলতা জয় করেও জাতি-সমাজে মাথা তুলে
দাঁড়াতে চেয়েছে। সারা
বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে
সে প্রয়াস দেখেছে।
সাহায্য, বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে তারা এগিয়ে
এসেছে। পৃথিবীর
আর কোনো দেশ বাংলাদেশের
মতো এত ঋণ, অনুদান,
বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়েছে বলে
আমার জানা নেই।
কিন্তু তাতে চূড়ান্ত লাভ
আমাদের কী হয়েছে? পদ্মায়
সেতু তৈরির মূলধন সংগ্রহ
করতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। বিশ্বব্যাংক
এবং অন্যান্য দাতা দেশ ও
সংস্থা খুবই সহজ শর্তে
আমাদের ঋণ দানের প্রস্তাব
দিয়েছিল। আমরা
যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের
২৮ দেশে শুল্কমুক্ত তৈরী
পোশাক রফতানির বাজার পেয়েছিলাম।
সে সুযোগ নষ্ট না
করলে পোশাক রফতানির ব্যাপারে
আমরা এত দিনে বিশ্বের
সেরা দেশে পরিণত হতে
পারতাম। কিন্তু
সেসব সুযোগ আমরা হেলায়
নষ্ট করেছি। পোশাক
রফতানির জিএসপি সুবিধা আমরা
হারিয়েছি ক্রেতাদেশগুলোর সাথে অহেতুক বিবাদ
ও বিতর্ক করে।
আমদানিকারক দেশগুলো এ শিল্পের উন্নতির
যেসব প্রস্তাব করেছিল, তাতে কার ক্ষতি
হতো? সরকারের? কারখানা মালিকদের? পোশাক শ্রমিকদের? কিংবা
বাংলাদেশের? এখন যে এ
শিল্প ধ্বংস হতে বসেছে,
এ বাজার যে আমাদের
হাতছাড়া হতে চলেছে, তাতে
লাভবান হচ্ছে কে? আমাদের
সাফল্যে যারা ঈর্ষাতুর ছিল
তারা। পদ্মা
সেতুর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ন্যায্য কিছু অভিযোগ ছিল। সেগুলো
সম্বন্ধে তদন্তে সরকারের অমন
প্রবল আপত্তির কারণ কী? অথচ
সে জন্য আমরা যা
হারিয়েছি তার তুলনা হয়
না। সেই
কবে পদ্মা সেতু দিয়ে
যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে
যেতে পারত। এখন
সরকার বলছে বটে যে,
নিজেদের সম্পদ থেকে তারা
সেতু তৈরি করবে।
কিন্তু তাতে মোট ব্যয়
যে কত গুণ বেড়ে
যাবে, হিসাব করে দেখেছেন
কেউ? প্রায়ই শুনছি সেতুর
কাজ শুরু ‘হচ্ছে, হলো’
বলে। সর্বশেষ,
পত্রিকায় পড়লাম সেতুর জন্য
দুই ষাঁড়, দুই পাঁঠা
আর দুই মোরগ ‘উৎসর্গ‘
(বলি) দেয়া হয়েছে, ‘কোরবানি’
দেয়ার কথা কেউ বলছেন
না। আমাদের
জাতীয় ঐতিহ্য আর ধর্মীয়
সংস্কৃতিও এখন আমরা ভুলতে
বসেছি।
জাতিসঙ্ঘ
মহাসচিব, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোপীয়
পার্লামেন্ট, চীন-জাপানসহ বহু
দেশের সরকার-প্রধান কিংবা
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বাংলাদেশে এসেছেন এক হাতে
সাহায্যের ডালি আর অন্য
হাতে বাংলাদেশে শান্তি ও গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে। তাদের
কথা আমরা শুনিনি।
প্রত্যেককে আমরা অপমান করেছি। অবশিষ্ট
ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু দিল্লিও এখন গণভবনের ওপর
নাখোশ মনে হচ্ছে।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা
দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরটিও নিশ্চয়তামূলক
নয়।
স্বাধীনতা
বিসর্জন দিয়ে প্রতিশোধ?
কিছু দিন অসুস্থ হয়ে
হাসপাতালে ছিলাম। বাংলাদেশের
দৈনন্দিন ঘটনাবলির সাথে যোগাযোগ রাখা
সম্ভব ছিল না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে
শুনি- মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে, দুই
বাংলা এক হয়নি কেন?
কী অদ্ভুত আর বিস্ময়কর
প্রশ্ন? সূর্য পূর্ব দিকে
ওঠে কেন? চাঁদকে কেন
আমরা রাতের আকাশেই ভালো
দেখি? কারণ কী? কারণ
এই যে সুদূর অতীতে
কিছু প্রাকৃতিক কার্যকারণ ঘটেছিল। দুই
বাংলা এক হয়নি কেন?
এসব প্রশ্নও উঠেছিল অতীতে; ১৯৪৬-৪৭ সালে।
মীমাংসা তখনই হয়ে গেছে। দুই
বাংলা এবং ভারতবর্ষ অভিন্ন
থাকার সুযোগ উপমহাদেশের মানুষকে
দেয়া হয়েছিল। সে
সুযোগের তারা সদ্ব্যবহার করেনি
বলেই দেশ ভাগ হয়েছে
এবং সে সঙ্গে বহু
আনুষঙ্গিক ঘটনা। সে
প্রশ্ন এখন কেন? যে
যার দেশ নিয়ে সন্তুষ্ট
থাকলেই তো সমাধান হয়ে
যায়? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতেই আছে,
কিন্তু অবশিষ্ট ভারত কি পশ্চিমবঙ্গকে
অথবা পশ্চিমবঙ্গ কি অবশিষ্ট ভারতকে
নিয়ে সন্তুষ্ট? উত্তর-পূর্ব ভারতের
সাতবোন নামে পরিচিত রাজ্যগুলোও
পশ্চিমবঙ্গ অথবা অবশিষ্ট ভারতের
সঙ্গে সদ্ভাবে আছে কি? তাহলে
অর্ধশতাব্দী ধরে কেন তারা
স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে?
দুই বাংলা এক থাকলে
যে মমতা ব্যানার্জি আর
শেখ হাসিনা পরম সৌহার্দ্যরে
সঙ্গে সে রাজ্য শাসন
করতেন, তারই বা নিশ্চয়তা
কী?
বাংলাদেশে
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬-১৭
জন কূটনীতিকের উদ্যোগের খবর পেলাম হাসপাতাল
থেকে বেরিয়ে। কিছুটা
আশাবাদীও হয়েছিলাম হয়তো। তাদের
প্রস্তাবে গ্রহণযোগ্য কিছু দিক ছিল। জাতিসঙ্ঘ
মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার
ফার্নান্দেজ তারানকো গত বছর যে
প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতেও গ্রহণযোগ্য দিক
ছিল। অনুসন্ধান
করা হলে এসব প্রস্তাবের
মধ্য থেকে সমাধান অবশ্যই
পাওয়া যেত। ঢাকা
থেকে এক বন্ধু ফোনে
বলছিলেন, দেশের মানুষ কিছুটা
আশাবাদী কূটনীতিকদের প্রস্তাব নিয়ে। এর
পরেই কিন্তু মুখ খুললেন
শেখ হাসিনা।
সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন,
বাংলাদেশের মাটিতে খালেদা জিয়ার
স্থান হবে না।
কেন হবে না? বাংলাদেশ
কি এতই ছোট দেশ?
নাকি বিশেষ কোনো নেতা-নেত্রী বা দল
বাংলাদেশের মালিক?
প্রধানমন্ত্রী
কি ভয় করছিলেন যে
কূটনীতিকদের চেষ্টা সফল হলে
তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না? সে
জন্যই কি আরেক প্যাঁচ
মোচড় দেয়া হলো? ৩৫
বছর ধরে প্রতিশোধ নেয়ার
চেষ্টা হচ্ছে। কী
লাভ হয়েছে তাতে? দেশের
অগ্রগতি হচ্ছে না।
হাজারে হাজারে মানুষ খুন
হয়েছে। খুন
কে করেছে, জিজ্ঞেস করে
লাভ নেই। সরকার
ও আওয়ামী লীগ এক
কথায় বলবে, খালেদা জিয়া
ও বিএনপি। সকাল-সন্ধ্যা খালেদা জিয়াকে খুনি
না বললে পেটের ভাত
হজম হয় না।
দেশ-বিদেশের মানুষ জানে অন্য
কথা। ‘ক্রসফায়ার’
আর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কথাগুলো এখন কদর্য ও
নিষ্ঠুর রসিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক
নেতাকর্মীদের গুম-খুনগুলো কারা
ঘটাচ্ছে, সবাই জানে।
ব্রিটিশ সরকার এখনো ইলিয়াস
আলীর মুক্তির জন্য এ সরকারের
ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতালাভের
গোড়ার দিকে জামায়াতের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকার
বিদেশীদের ‘ইমপ্রেস’ করার চেষ্টা করেছিল;
দাবি করেছিল যে, তারা
বাংলাদেশ থেকে আলকায়েদা ও
ইসলামি সন্ত্রাস দূর করার চেষ্টা
করছে সুতরাং সবার উচিত
তাদের সমর্থন দেয়া।
অভিজিৎ হত্যা নিয়ে নতুন
চাল চেলেছেন তারা। বিদেশীদের
তারা বলতে চাইছেন, বাংলাদেশে
নতুন করে ইসলামি সন্ত্রাস
দেখা দিয়েছে। আওয়ামী
লীগ গদিতে না থাকলে
সে সন্ত্রাস দূর হবে না।
ইরাকের
আইএস বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু কোনো দেশের কোনো
সরকার এ প্রচারণার ফাঁদে
পা দিচ্ছে বলে মনে
হয় না। পুলিশ
যেখানে হাজির ছিল সেখানে
কী করে এই জঘন্য
হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারল, সে
ব্যাখ্যাই সবাই চায়।
অভিজিতের বাবা বলেছেন, ফারাবীকে
গ্রেফতার করে কী লাভ
হলো, সে তো সে
চারুকলাতেই ছিল না।
আমরা জানি ১৯৮১ সালে
যে প্রতিশোধস্পৃহাকে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ছেড়ে
দেয়া হয়েছে, দেশের লোকসান
এবং বিভিন্ন খুনের জন্য সেটাই
দায়ী। কিন্তু
সেই স্পৃহার কি সীমা-পরিসীমা
থাকতে নেই?
সিরাজুর
রহমান
লন্ডন,
০৯.০৩.১৫
serajurrahman34@gmail.com
প্রথম পর্ব লিংক : প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(প্রথম পর্ব ) - সিরাজুর রহমান
দ্বিতীয় পর্ব লিংক : প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(দ্বিতীয় পর্ব) - সিরাজুর রহমান
Comments
Post a Comment