ভয়াবহ সাংবিধানিক শূন্যতায় সর্বোচ্চ আদালত - ডক্টর তুহিন মালিক

ভয়াবহ সাংবিধানিক শূন্যতায় সর্বোচ্চ আদালত - ডক্টর তুহিন মালিক

ভয়াবহ সাংবিধানিক শূন্যতায় সর্বোচ্চ আদালত - ডক্টর তুহিন মালিক
ভয়াবহ এক সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে দেশে কোনো আইন-কানুন কিছুই নেই সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ অপসারণের বিষয়ে। তা ছাড়া সর্বোচ্চ আদালতে অতিরিক্ত বিচারপতিদের নিয়োগ-স্থায়ীকরণ, জ্যেষ্ঠতা প্রদান, আপিল বিভাগে নিয়োগ-পদোন্নতি, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভ সব কিছুই চলছে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির বদলে সম্পূর্ণ একক-ব্যক্তিক সিদ্ধান্তে। এমনকি এখন কোনো আইন ছাড়াই চলছে সর্বোচ্চ আদালত এর বিচারকদের অবমাননার বিচার।


এক. কোনো আইন ছাড়াই ৪২ বছর ধরে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৯৫()() অনুচ্ছেদে আইন তৈরি করে বিচারক নিয়োগের কথা উল্লেখ থাকলেও কোনো সরকারই আজ অবধি আইনটি প্রণয়ন করেনি। ইচ্ছা করেই সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ২০১০ সালের জুন বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট বিধি নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন। চার বছর পার হয়ে গেল সরকার এখনো নির্বিকার। অন্যদিকে ২০১২ সালে আইন কমিশনও বিচারক নিয়োগে আইন তৈরির সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে। আইন তো করাই হয়নি বরং বিচারক নিয়োগে নির্বাহী প্রধানের পছন্দ-অপছন্দকে আরও বেশি শক্তিশালী করা হয়েছে। আইন করে বিচারক নিয়োগের কথা বললেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আজ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। সংক্রান্ত কোনো আইন না থাকার কারণে সম্পূর্ণ ফ্রি-স্টাইলে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রপতি এখন নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান। এর ফলে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা রাষ্ট্রপতির জন্য এখন বাধ্যতামূলক। সংশোধিত রুল অব বিজনেসে বিচারকদের নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইলগুলো প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার স্পষ্ট বিধানও রাখা হয়েছে। স্বাধীন বিচারবিভাগ হচ্ছে গণতন্ত্রের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ৬৫ অনুচ্ছেদে সংসদকে আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আবার ৫৫() অনুচ্ছেদে একচ্ছত্র নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। রাষ্ট্রের দুটো বিভাগেরই একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আর তৃতীয় স্তম্ভ বিচারবিভাগের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, পদোন্নতি, অপসারণ সবই কার্যত চলে গেছে প্রধানমন্ত্রীরই হাতে। দুই. বিচারপতি নিয়োগের আইন না করে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে পাস করা হলো বিতর্কিত ষোড়শ সংশোধনী। এতে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বাতিল করা হলো। এই মুহূর্তে বিচারপতি অপসারণে কোনো আইনের অস্তিত্ব দেশে বিদ্যমান নেই। ষোড়শ সংশোধনী পাসের আগেই বিচারপতি নিয়োগ এবং অপসারণের আইন দুটি প্রণয়ন করাটা খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। অথচ সরকার দুটোকেই অকার্যকর করে হিমঘরে ঢুকিয়ে দিল। আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তিন মাসের মধ্যে অপসারণ আইনটি পাস করা হবে। তাহলে তিন মাসের মধ্যে আইনটি প্রণয়ন করে তারপর ষোড়শ সংশোধনী পাস করালে কি- বা ক্ষতি হতো? আসলে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি আমাদের একটা স্বচ্ছ আইন নীতিমালা থাকত তাহলে অপসারণের বিষয়টা হয়তো এতটা আতঙ্কজনক হতো না। নিয়োগ প্রক্রিয়ার কার্যকর আইন থাকার কারণে ইংল্যান্ডে ১৮৩০ সালের পর থেকে আজ অবধি কোনো বিচারককে অপসারণের প্রয়োজনই দেখা দেয়নি। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণে কোনো তদন্ত প্রমাণের পদ্ধতি বিষয়ে কোনো আইন তৈরি না করে এটাকেও সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ন্যায়পাল ব্যবস্থার মতো চির-অকার্যকর করে রাখা হলো।

তিন. সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে হাইকোর্টে দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। আবার রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে কোনো অতিরিক্ত বিচারককে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। এই স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার লোভে অতিরিক্ত বিচারকদের সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার দুবছরে তার সবটুকুই করতে দেখা যায়। এমনকি এখন তো অনেক ডিভিশন বেঞ্চে জুনিয়র অতিরিক্ত বিচারকদেরই বেশিমাত্রায় সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিনিয়র বিচারকদের পর্যন্ত বিব্রত হতে হচ্ছে। নবম জাতীয় সংসদে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির বিষয়ে স্পিকারের রুলিংকে 'অকার্যকর' বলে বর্ণনা করে হাইকোর্ট।

'দিন আগে সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত বিচারপতির নিয়োগ স্থায়ী করেননি তৎকালীন স্পিকার যিনি বর্তমানে রাষ্ট্রপতি। এতে তিনি সংক্ষুব্ধ হয়ে রাষ্ট্রপতির দফতরে আইউন নোটিস পাঠান। এরপর দুটো রিট পিটিশন দাখিল করা হয় সেই বিচারপতির পক্ষে। কিন্তু দুটো মামলাই খারিজ করে দেন আদালত। অথচ বিএনপি সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত ১৯ জন অতিরিক্ত বিচারককে স্থায়ী না করলে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সেই ১৯ জন বিচারকের নিয়োগ প্রদানের পক্ষে রায় দেন। সরকার এখন ইচ্ছামাফিক যে কাউকে স্থায়ী করতে পারছে। আবার সরকারের পছন্দ না হলে যে কোনো অতিরিক্ত বিচারপতিকে বিদায়ও দিতে পারছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিক পরামর্শের স্থলে প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শ অর্থাৎ ফুল কোর্টের পরামর্শ নেওয়াটা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।

চার. সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকদের পদোন্নতি আর সুপারসিডের নজির নতুন কিছু নয়। সুপারসিডের নামে চলছে মহাপ্রলয়। সরকারের পছন্দের বিচারক না হলে সারা জীবন হাইকোর্টেই থেকে যাওয়ার নজির এখন অনেক পাওয়া যাবে। আবার জ্যেষ্ঠতার একদম নিচে অবস্থান করা বিচারককে আপিল বিভাগে উন্নীত করার বিরল ঘটনাও এখন ঘটে যাচ্ছে। আসলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় কি-না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘদিনের কনভেনশনে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতির রেওয়াজই এতদিন চালু ছিল। এমনকি জ্যেষ্ঠ বিচারকরাই প্রধান বিচারপতি হবেন এটাই এক সময় খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। আর এখন দলীয় আনুগত্য আর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই মুখ্য হয়ে পড়েছে। পাঁচ. সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সরকারি লোভনীয় পদে এমনকি মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বানানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতেই হয়েছে বড় সর্বনাশ। অবসর গ্রহণের পরও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ লোভনীয় রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ পাওয়ার বিধান থাকার কারণে বিচারকরা সরকারকে খুশি করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অবসর নেওয়ার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে কর্মরত। তিনি ষোড়শ সংশোধনীর মূল মুসাবিদাকারী। অথচ বিচারপতি থাকাকালীন তিনি সংবিধানের পঞ্চম সপ্তম সংশোধনী বাতিলের মামলায় মিলিটারি শাসনের সব আইনকে বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদটি বাতিল করেননি। এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে তিনি নিজেই নিজের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন।

ছয়. কেউ বিশ্বাস করবেন কি না যে, দেশে এখন আদালত অবমাননার কোনো আইনই নেই। ১৯২৬ সালের একটি আইন ছিল। কিন্তু সেটাও বছর কয়েক আগে হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছেন। যদিও আদালত অবমাননার শুনানি বিচার করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা হাইকোর্টের রয়েছে। আইন না থাকাবস্থায়ও অপরাধের ধরন, সংজ্ঞা, পরিধি, প্রয়োগ, প্রক্রিয়া, শাস্তি প্রভূত বিষয়ে মারাত্দক আইনি শূন্যতা বিরাজ করছে এখন আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, সকলের আস্থাভাজন, নিরপেক্ষ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আমি পরাজিত হতে যাচ্ছি। এর কারণ আমার ক্ষমতার অপর্যাপ্ততা এবং সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির কোনো হাত নেই। তিনি সেখানে 'মিস্টার নোবডি' আসলে আমাদের পুরো বিচার বিভাগকেই 'মিস্টার নোবডি' করে রাখা হয়েছে প্রতিটি সরকারের আমলেই। তাদের চিন্তা একটাই, আদালতকে থাকতে হবে তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রয়োজনে আদালতকে করে রাখা হবে 'ঠুটো জগন্নাথ'

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ


e-mail: malik.law.associates@hotmail.com

Comments

Social Share Icons

Popular Posts

শীঘ্রই বাংলাদেশও আমাদের হবেঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে নিউজটি ভুয়া ছিল স্বীকার করতে বাধ্য হলো ডেইলি স্টার

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে” - তরিকুল ইসলাম (সাবেক মন্ত্রী)