প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(দ্বিতীয় পর্ব) - সিরাজুর রহমান

প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি(দ্বিতীয় পর্ব) - সিরাজুর রহমান

প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি - দ্বিতীয় পর্ব ( #PoliticalRevenge )
সিরাজুর রহমান, প্রয়াত সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা বিভাগ
উৎস : প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি : অন্য দিগন্ত
দ্বিতীয় পর্ব - সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বোন-ভগ্নিপতি শামসুন্নাহার আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠ কন্যা শিরীনের সাথে আমার পুত্র সাইফুর রহমানের বিয়ে বিবিসি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেবে না জানতাম অগত্যা আমাকে বাদ দিয়েই বরযাত্রীরা ঢাকায় চলে গেলেন কিন্তু অপূর্ব সুযোগ এসে গেল হঠাৎ সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাথে বিরোধ বাধিয়ে তুললেন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের দাবি তুলে আমাকে অবিলম্বে ঢাকা যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো স্থির হলো, আমার সহকর্মী রিচার্ড অপেনহাইমারও কয়েক দিনের মধ্যেই আমার সাথে যোগ দেবেন
রিচার্ড আর আমি রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সাক্ষাৎকার নেই বঙ্গভবনের প্রেস রুমে ১৯৮২ সালের ১৫ জানুয়ারি সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিস আর তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরী শেরাটন হোটেলে নিজের কামরায় গিয়ে সবে বসেছি টেলিফোন বাজল একটা অপরিচিত ভারী গলা জানতে চাইল ভিআইপি (রাষ্ট্রপতি) তার সাক্ষাৎকারে আমাকে কী বলেছেন
রাষ্ট্রপতির সাথে আমাদের কথাবার্তা এতই স্পষ্ট ছিল যে, কোনো কিছু গোপন করার প্রয়োজন বোধ করিনি বললাম, রাষ্ট্রপতি বলেছেন মাত্র অল্প দিন আগে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে, সংবিধানের প্রয়োজন মিটেছে লোকটি জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট তো আপনাকে আরো বলেছেন যে, সেনাপ্রধানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের দাবি তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়

আমি বললাম, হ্যাঁ, সে কথা তিনি আমাকে বলেছেন, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? হেসে বললাম, বঙ্গভবনের কার্পেটের কান আছে বলে তো শুনিনি কলার টেলিফোনে বললেন, আপনি এই টেলিফোনের কাছেই থাকুন আপনাকে আরেকটা ভিআইপি ইন্টারভিউ নিতে হবে সারা দিন অপেক্ষা করার পর সন্ধ্যায় নতুন বেয়াই-বেয়ানের বাড়িতে খেতে গেছি হোটেলে টেলিফোন নম্বর রেখে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ পর পরিচিত এক ব্যক্তি এলেন সেখানে প্রস্তাবিত ভিআইপির প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন বলে দাবি করলেন আমার স্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, লন্ডনে আমাদের বাড়িতে বেড়াতেও এসেছিলেন আরো পরিচয় দিলেন তিনি তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের ভগ্নিপতি সেনাপ্রধান স্থির করেছেন, তার প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়ার সময় হয়নি ভগ্নিপতিকে পূর্ণ ব্রিফিং দিয়ে তিনি তার বক্তব্য আমাকে বুঝিয়ে বলতে পাঠিয়েছেন
ভগ্নিপতি যা বললেন, তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সেনাপ্রধান বলে পাঠিয়েছেন একটা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে তিনি আপসবিমুখ; রাষ্ট্রপতি ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তের ওপর কাউন্সিলের ভেটো ক্ষমতা থাকতে হবে তার দাবি মেনে নেয়া না হলে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা স্বহস্তে তুলে নিতে বাধ্য হবেন আমার জন্য বিশেষ সমস্যা ছিল, তার বক্তব্য অবশ্যই বিবিসি থেকে প্রচারের অনুরোধ জানিয়েছেন ভিআইপি অনেক ভেবেচিন্তে পরের দিন ভোরের ফ্লাইটে কলকাতা চলে যাই ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা থেকে এই স্পর্শকাতর প্রতিবেদন পাঠানো বেশি নিরাপদ বোধ করেছিলাম
ঢাকপেটানো সামরিক অভ্যুত্থান
পরের ইতিহাস সবারই জানা দুই মাস পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন বিএনপির নতুন অনভিজ্ঞ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবিলম্বে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেও দেশের প্রাচীনতম অধিকতর শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত জ্ঞাপন করেছিল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি অখুশি হননি আওয়ামী লীগের পত্রিকা দৈনিক বাংলার বাণী প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধে সামরিক সরকারের সাফল্য কামনা করে
কথা কমবেশি সবারই স্বীকার করে যে, সামরিক স্বৈরতন্ত্র গেড়ে বসতে পারে গণতন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলে স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্র কখনোই একসাথে টিকে থাকতে পারে না আর স্বৈরতন্ত্র যত বেশি দিন বজায় থাকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ততই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এরশাদের অভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হবে, রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা যে অনেক পিছিয়ে যাবে, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো সন্দেহ ছিল না তা সত্ত্বেও সভানেত্রীসহ আওয়ামী লীগ এরশাদের স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত করেছিল ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, মূলত আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সমর্থনেই এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রায় নয় বছর স্থায়ী হতে পেরেছিল এর একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব রাষ্ট্রের এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে জেনেও প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আওয়ামী লীগ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনে ইন্ধন জুগিয়েছিল

ছাত্রজনতার ঐক্যবদ্ধ দাবিতে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত বিএনপি খালেদা জিয়ার সাথে একযোগে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য হয় এরশাদের পতন ঘটে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আরো একটা অপূর্ব সুযোগ এসেছিল এমনকি সে নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকেই বাস্তব মনে করেছিলেন কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন আগে ১৯৯১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে টেলিভিশনে তার ৪৫ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় অর্থহীন বিষোদগার প্রচারের পর সারা বিশ্বের পর্যবেক্ষকেরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন

Comments

Social Share Icons

Popular Posts

শীঘ্রই বাংলাদেশও আমাদের হবেঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে নিউজটি ভুয়া ছিল স্বীকার করতে বাধ্য হলো ডেইলি স্টার

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে” - তরিকুল ইসলাম (সাবেক মন্ত্রী)