চলে গেলেন আমাদের প্রিয় আরাফাত রহমান কোকো

মায়ের কাছ থেকে চিরবিদায়

Muktobak24: ঢাকামঙ্গলবার, ২ জানুয়ারী ২০১৫


আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে ঢোকানো হয় বেলা পৌনে ২টার দিকে। এরপর খয়েরি রঙের কফিনটি নিচ তলার একটি কক্ষে রাখা হয়। কফিন খোলার পর একটি গিলাফ দিয়ে কোকোর মরদেহ ঢেকে দেওয়া হয় । কিছুক্ষণ পর দুই ভাইয়ের স্ত্রী দুই পাশ থেকে ধরে অশ্রুসিক্ত খালেদা জিয়াকে নিচে নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে মৃত ছেলের মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেন খালেদা জিয়া। এসময় শেষ বারের মত প্রিয় সন্তানের মুখে হাত বুলিয়ে দেন তিনি। তখন উপস্থিত সবাইকেই কাঁদতে দেখা যায়। এরপর দোয়া করা হয় কোকোর আত্মার শান্তি কামনা করে। দোয়ায় খালেদা জিয়াসহ সবাই শরিক হন। তার পরই মায়ের কাছ থেকে চিরবিদায় নেন কোকো। কোকোর লাশবাহী অ্যাম্বুলেসটি বিকেল পৌনে তিনটার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ভেতর থেকে বের করা হয়। এরপর সেটি প্রধান জানাযার নামাজের জন্য বায়তুল মোকাররমের দিকে রওনা দেয়।। বাদ আছর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা হয়। বাদ মাগরিব কোকার লাশ দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে। ৭ বছর আগে ২০০৮ সালে সেনা সমর্থক মইন-ফখরুদ্দিনের সরকার কোকোকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এরপর আর তার দেশে ফেরা হয়নি। ২০১২ সালে ব্যাংককে একবারই মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। গুলশান কার্য়ালয়ে মা খালেদা জিয়া তিন সপ্তাহ থেকে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে -এ নিয়ে দুই ছেলে তারেক ও কোকো উদ্বিগ্ন ছিলেন। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার আগের রাতেই মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোকো ফোন কথা বলে তার উদ্বেগেরে কথাও জানিয়েছিলেন। 
৭ বছর পর মঙ্গলবার কোকো বাংলাদেশে পিরে আসেন ঠিকই। তবে লাশ হয়ে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ওসাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট সন্তান কোকের প্রতি দেশের মানুষ যে ভালোবাসা দেখিয়েছে, তা বিরল। 
এর আগে দুপুর দেড়টার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ আনা হয়। গত ৩ জানুয়ারি থেকে এখানেই অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া।
এখানে সকাল থেকে জড়ো হওয়া বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীদের ভিড় ঠেলে লাশবাহী গাড়ি কার্যালয়ের ভেতরে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। প্রায় ২০ মিনিট পর গাড়িটি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে পারে।
এরপর মরদেহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে সচরাচর যেখান থেকে ব্রিফিং দেওয়া হয় সেখানে রাখা হয়। এখানে এসেই খালেদা জিয়া শেষবারের মত তার ছেলের মরদেহ দেখেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১২ বছর বয়স থেকে যাকে তিনি বুকে আগলে রেখেছিলেন।
মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুলশান কার্যালয়ের দিকে রওনা হয় কোকোর মরদেহবাহী আলিফ মেডিকেল সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্স।
এর আগে মালয়েশিয়া থেকে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে কোকোর লাশ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। সেখানে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ বুঝে নেন তার চাচাতো ভাই মাহবুবুল আলম ডিউক ও বিএনপির নেতারা।
ডিউকের সঙ্গে ছিলেন- বিএনপির শীর্ষ পাঁচ নেতা- স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আবদুল্লাহ আল নোমান ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী।
কোকোর মরদেহ আসার খবরে বিমানবন্দর এলাকায় বিপুলসংখ্যক বিএনপির নেতাকর্মী সকাল থেকে ভিড় করেন। এ সময় লাশ বের হওয়ার গেটে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান, মীর নাছির হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফললুল হক মিলন।
কোকোর মরদেহ আসা উপলক্ষে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। ওই এলাকায় সীমিত করা হয় যান চলাচল।
উল্লেখ্য, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত শনিবার মালয়েশিয়ায় মারা যান আরাফাত রহমান কোকো। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি ২০১২ সাল থেকে দেশটিতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন।

কোকো জানাজা  ছিল সরণকালের ইতিহাসের সর্ববৃহত্তম জানাজা
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জিয়া পরিবারের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় অংশ নিয়েছে লাখো মানুষ। আহাজারি করেছেন দলের নেতাকর্মীরা। এদিকে সাবেক সেনাপ্রধানের ছেলে হিসেবে বনানী সামরিক কবরস্থানে কোকোর দাফনের অনুমতি চাওয়া হলেও সরকারের তরফে অনুমতি মেলেনি। ফলে বায়তুল মোকাররমে দ্বিতীয় জানাজা শেষে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ দাফন করা হয় বনানীর সিটি করপোরেশন কবরস্থানে। 

শেষ যাত্রায় লাখো মানুষ
বায়তুল মোকাররমের জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পেরিয়ে বলাকা চত্বর, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ পেরিয়ে গুলিস্তান ফ্লাইওভার পর্যন্ত পুরো সড়ক ভরে ছিল জানাজায় অংশ নেয়া মানুষে। বায়তুল মোকাররম মসজিদকে কেন্দ্র করে চারপাশের এলাকা পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। জানাজায় অংশ নেয়া মানুষের ভিড়ের কারণে আসরের নামাজের আগেই বন্ধ করে দেয়া হয় পল্টন মোড় থেকে মতিঝিল অভিমুখী এবং জিরোপয়েন্ট থেকে গুলিস্তান নাট্যমঞ্চ অভিমুখী রাস্তা। বিকাল তিনটার পর থেকে বায়তুল মোকাররম ও আশপাশে জমায়েত হতে শুরু করে বিএনপিসহ ২০দলীয় জোটের নেতাকর্মী-সমর্থক ও বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লাখো মানুষ। নেতাকর্মীদের বুকে ছিল কালো ব্যাজ। এ সময় অপেক্ষারত মানুষ কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে জিকির করতে থাকেন। এসময় কোকোর অকাল মৃত্যুর কারণে আহাজারি করতে দেখা গেছে অনেককেই। এর আগে দুপুর পৌনে তিনটায় গুলশান থেকে রওনা দিলেও লাশবাহী এম্বুলেন্সটি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে এসে পৌঁছে বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে। 

জানাজার আগে আরাফাত রহমান কোকোর ছোট মামা শামীম এস্কান্দার মসজিদের মাইকে কোকোর জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কোকো যদি কোন ভুলত্রুটি ও অন্যায় করে থাকে তাহলে আপনারা ক্ষমা করে দেবেন। কোকোর কাছে যদি কারও দেনা-পাওনা থাকে তাহলে আপনারা আমাদের জানাবেন। আমরা তা পরিশোধ করে দেবো।’ বাদ আসর ৫টা ১৫ মিনিটে কোকোর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজ পড়ান বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা সালাউদ্দিন আহমদ। এদিকে জানাজা শেষে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কফিন নিয়ে যাওয়া হয় মসজিদের পশ্চিম পাশে খোলা স্থানে। সেখানে সাধারণ মানুষের দেখার জন্য কিছুক্ষণের জন্য কফিনের মুখ খুলে দেয়া হয়। সেখানে কফিনে ফুল দেয়া হয়। তবে বিপুল সংখ্যক লোক সমাগমের কারণে দ্রুতই মুখ বন্ধ করে তার মরদেহ সরাসরি বনানীর সিটি করপোরেশন কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য, রোববার দুপুরে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের জাতীয় মসজিদ নাগারায় আরাফাত রহমান কোকোর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

রোববার সেখানে জানাজা শেষে কুয়ালালামপুরের একটি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা ছিল কোকোর মরদেহ। মঙ্গলবার সকালে দলের পক্ষ থেকে সারা দেশে গায়েবানা জানাজা আয়োজন করা হয়। কোকোর একমাত্র ভাই তারেক রহমান রোববার লন্ডনে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে- স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর, মীর মো. নাছির উদ্দিন, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, মে. জে. (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস কাদের চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগই জানাজায় অংশ নেন। জানাজায় রাজনীতিকদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিকল্পধারা সভাপতি প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক-শ্রমিক-জনতা পার্টির সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিকল্পধারা মহাসচিব আবদুল মান্নান, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, সাহাদাত হোসেন সেলিম, জামায়াতের নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, রিদওয়ান উল্লাহ শাহেদী, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের আমীর অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাক, মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান, এনডিপি সভাপতি খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান আবদুল মোবিন, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ ন্যাপের সভাপতি জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া প্রমুখ। এদিকে জানাজায় অংশ নেয়া লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, কোকোর জানাজায় অংশ নিতে সোম ও মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়েছেন। কোকোর কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না দাবি করে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে তার জানাজায় শরিক হওয়ার আহ্বান জানানো হয় বিএনপির তরফে। এদিকে আরাফাত রহমান কোকোর প্রতি সম্মান জানাতে তিনদিনের শোক পালন করছে বিএনপি। দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, নেতাকর্মীরা বুকে কালোব্যাজ ধারণ ও সারা দেশে মসজিদে মসজিদে কোরআনখানি এবং দোয়া মাহফিল আয়োজন করছেন দলের নেতাকর্মীরা। 

পল্টনে কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী: এদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজাকে কেন্দ্র করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী। সকাল থেকে ওই এলাকার আশপাশের রাস্তায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। সাদা পোশাকেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলার মোড় এবং গুলিস্তানে একাধিক জলকামান ও রায়টকার টহল দিতে দেখা যায়। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এছাড়াও বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশের আশপাশের উঁচু ভবনগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য অবস্থান করছিলেন। মসজিদের ভিতরে কিছু গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অবস্থান নেন। তবে জানাজা শেষে পুলিশের জলকামান ও রায়ট কারগুলো অধিক হর্ন দিয়ে রাস্তায় চললে জানাজায় অংশ নেয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এসময় বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হন। তবে কোন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। মতিঝিল জোনের পুলিশের ডিসি সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকোর নামাজে জানাজা হবে তা রাতেই জানতে পেরেছি। এ উপলক্ষে রাত থেকেই ওই এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সতর্ক ছিল। 

‘আমার কোকো বলেই কেঁদে ওঠেন খালেদা’
বেলা ১টা ৩০ মিনিট। আলিফ মেডিকেল সার্ভিসের এম্বুলেন্সযোগে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ এসে পৌঁছে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে। একটি কালো গাড়িতে করে এম্বুলেন্সের পেছন পেছন আসেন কোকোর স্ত্রী শর্মিলী রহমান ও দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান এবং জাহিয়া রহমান। কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে কার্যালরে ভেতরে এম্বুলেন্সটি প্রবেশ করাতে বেগ পেতে হয়। ভিড় ঠেলেই কোকোর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। কার্যালয়ের উত্তরদিকের ফটক দিয়ে লাশবাহী এম্বুলেন্সটি ঢোকাতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লেগে যায়। ১টা ৪৮ মিনিটে এম্বুলেন্সে রাখা কফিন থেকে কোকোর মরদেহ বের করা হয়। এসময় আরবি হরফে লেখা একটি চাদর দিয়ে কোকোর মরদেহ ঢেকে কার্যালয়ের ভেতরে নেয়া হয়। তার মরদেহ কার্যালয়ের নিচতলার সংবাদ সম্মেলন কক্ষে খয়েরি রঙের কফিনে রাখা হয়। প্রায় ১০ মিনিট পর কার্যালয়ের দোতলা থেকে দুই ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ও কানিজ ফাতেমার কাঁদে ভর করে নিচে নেমে আসেন খালেদা জিয়া। কফিনের ভেতর ছেলের নিথর দেহ দেখে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। 
নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এরপর ‘আমার কোকো আমার কোকো’ বলেই আদরের ছোট সন্তানের মুখ ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। শেষবারের মতো মমতাময়ী মায়ের হাতের স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন প্রাণহীন ছেলের মুখে। এসময় খালেদা জিয়াকে দুই পাশ থেকে ধরে রাখেন দুই ভাইয়ের স্ত্রী ও কোকোর স্ত্রী। এরপর কফিনের পাশে বসে দুই নাতনি জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এসময় পাশে বড় বোন সেলিনা ইসলাম, দুই ভাইয়ের স্ত্রী, বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু, জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দু এবং কোকোর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে কাঁদতে দেখা যায়। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে কার্যালয়ের পরিবেশ। এরপর ছেলের কফিনের সামনে বসেই মোনাজাতে শরিক হন খালেদা জিয়া। 

কিছুক্ষণ পর মায়ের সামনেই ছেলের কফিনটি ঢেকে দেয়া হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক রাখার পর কফিনটি যখন কার্যালয় থেকে বের করে এম্বুলেন্সে তোলা হয় তখন অঝোরে কাঁদতে থাকেন খালেদা জিয়া। দুই ভাইয়ের স্ত্রীর কাঁধে ভর করে দরজায় দাঁড়িয়ে ছোট ছেলেকে শেষবিদায় জানান তিনি। যতক্ষণ ছেলের লাশবাহী এম্বুলেন্সটি কার্যালয়ের ভেতরে ছিল ততক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন লাশবাহী এম্বুলেন্সের দিকে। বেলা ২টা ৪০ মিনিটের দিকে জানাজার জন্য এম্বুলেন্সটি কার্যালয় থেকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উদ্দেশে রওনা হয়। এরপর খালেদা জিয়াকে ধরাধরি করে কার্যালয়ের দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। আরাফাত রহমান কোকোর লাশ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের নেয়ার পর সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অশ্রুসিক্ত নয়নে খালেদা জিয়া যখন তার ছোট ছেলেকে শেষ বিদায় জানান তখন উপস্থিত নেতাকর্র্মীদের অনেকের চোখ ছিল অশ্রুসজল। 

এর আগে কার্যালয়ের নিচতলার কক্ষে আরবি হরফে লেখা একটি ব্যানার টানানো হয়। এছাড়া সকাল থেকে কার্যালয়ের ভেতরে খালেদা জিয়ার নিকটাত্মীয়, দলের সিনিয়র নেতা ও কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পাশের কক্ষে জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সেলিম রেজা, প্রচারণা ও প্রকাশনা সম্পাদক মাওলানা দ্বীন মোহাম্মদ কাশেমীর নেতৃত্বে সকাল থেকে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। এছাড়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রধান নিরাপত্তা সমন্বয়কারী মেজর (অব.) আবদুল মজিদ এবং সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ওদিকে আরাফাত রহমান কোকোকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে সকাল থেকে কার্যালয়ের সামনে ৮৬ নম্বর সড়কে ভিড় জমান দলীয় নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতা। বেলা দেড়টার দিকে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ কার্যালয়ের সামনে পৌঁছালে লাশ দেখার জন্য নেতাকর্মীদের হুড়োহুড়ি লেগে যায়। এসময় উদ্দেশে শিমুল বিশ্বাস মাইকে নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং বায়তুল মোকাররমের জানায় শরিক হওয়ার অনুরোধ করেন। 

বিমানবন্দরের বাইরে মানুষের ঢল: ওদিকে সকাল ১১টা ৪১ মিনিটে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট-১০২) বিমানটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। কোকোর মরদেহের সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী শর্মিলী রহমান, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান, মামা শামীম ইস্কান্দার, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু, শামীম ইস্কান্দারের শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, কোকোর মামাশ্বশুর এবং মালয়েশিয়া বিএনপির ২০-২৫ জন নেতা। বিমানটি অবতরণের পর বিমানবন্দর থেকে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল কোকোর লাশ গ্রহণ করেন। এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরীও ওই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন। তারা সবাই কালোব্যাজ ধারণ করে ছিলেন। 

এর আগে বেলা ১১টার দিকে এ প্রতিনিধি দলটি বিমানবন্দরে পৌঁছান। ওদিকে কোকোর মরদেহ দেশে আনার সংবাদে সকাল থেকে রাস্তার দু’দিকে কালোব্যাজ পরিহিত অবস্থায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের হাজার-হাজার নেতাকর্মী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এদিকে বিমানবন্দরের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আলিফ মেডিকেল সার্ভিসের লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সে করে কোকোর লাশ গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের দিকে নেয়া হয়। এ সময় বিমানবন্দরের গেট থেকে হাজার-হাজার নেতাকর্মী লাশবাহী গাড়িবহরের সঙ্গে ছিলেন। গাড়িবহরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গাড়িসহ কয়েকশ’ মোটরসাইকেলও ছিল। বিমানবন্দর থেকে গুলশান কার্যালয়ে লাশবাহী এম্বুলেন্সটি পৌঁছতে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা সময় লাগে। 
বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা: সোমবারই প্রচার হয়ে যায় মঙ্গলবার আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ আসার খবর। এ খবর পেয়ে সকাল থেকেই বিমানবন্দর এলাকায় ভিড় জমায় বিএনপি’র বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। বিমানবন্দরের দু’টি গেটেই অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু তাদের কাউকেই বিমানবন্দরে ঢুকতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি বিদেশগমনেচ্ছু এবং বিমানবন্দরে কর্মরতদেরও ওই সময় ঢুকতে দেয়া হয়নি। তবে বিমানের টিকিট দেখে কাউকে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়। তবে সঙ্গে কোন স্বজনও যেতে পারেননি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন মানুষজন। এমনকি গেটেও মানুষজনকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। প্রধান গেট থেকে উত্তর পাশের (কার্গো গেট) থেকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে এমন কথা বলা লাশবাহী এম্বুলেন্সটি বিমানবন্দর ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ-ই ঢুকতে পারেননি। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানায়, কোকোর লাশ আসা উপলক্ষে বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো বিমানবন্দর এলাকা ঘিরে রাখে মহানগর পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্য ও দাঙ্গা পুলিশ। তারা মোটরসাইকেলসহ সকল ধরনের যান চলাচলও বন্ধ করে দেয়।
বনানী কবরস্থানে দাফন 

এদিকে বায়তুল মোকারর জাতীয় মসজিদ থেকে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে দাফনের জন্য বনানী কবরস্থানের পথে রওনা হয় আরাফাতের কফিনবাহী আলিফ মেডিকেল সার্ভিসের গাড়িটি। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কফিন মসজিদ থেকে বের করতে নিরাপত্তাকর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। এরপর পৌনে ৭টার দিকে বনানী কবরস্থানে নিয়ে দাফন করা হয় কোকোকে। বিএনপির নেতাদের পাশাপাশি বহু কর্মী দাফনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। 

উল্লেখ্য, গত ২৪শে জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান আরাফাত রহমান কোকো। ২০০৭ সালের ১৭ই জুলাই কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান কোকো। এরপর থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। সাত বছর পর তিনি দেশে ফিরলেন লাশ হয়ে।

Comments

Social Share Icons

Popular Posts

শীঘ্রই বাংলাদেশও আমাদের হবেঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে নিউজটি ভুয়া ছিল স্বীকার করতে বাধ্য হলো ডেইলি স্টার

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে” - তরিকুল ইসলাম (সাবেক মন্ত্রী)