ফেলানী খাতুন হত্যার বিচারের নামে তামাশা

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে
ফেলানী খাতুন হত্যার বিচারের নামে তামাশা
Saturday, July 04, 2015
Muktobak24: বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী খাতুন হত্যার পুনর্বিচারেও অভিযুক্ত ভারতীয় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ নির্দোষ বিবেচিত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফেলানীর স্বজন, প্রতিবেশী, মানবাধিকার সংগঠন বিশিষ্টজনরা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘ফেলানী হত্যার পুনর্বিচারের রায়ে আমরা হতবাক ও  মর্মাহতফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেছেন, ‘ভারত সরকার বিচারের নামে তামাশা করেছেঅন্যদিকে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মাসুম একেলোক দেখানো বিচারভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থীবলে অভিহিত করেছে রায়কে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি কুড়িগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘ রায় ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে

গত বৃহস্পতিবার ভারতের কোচবিহারে বিএসএফের ১৮১ ব্যাটালিয়নের সদরদফতরের সোনারি ক্যাম্পে আদালত বসে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা করে কোর্ট মার্শালের সমতুল্য বিএসএফের নিজস্ব আদালত রায়ে অমিয় ঘোষকে খালাস দেন তবে বিএসএফ আনুষ্ঠানিকভাবে রায়ের কথা ঘোষণা করেনি মহাপরিচালকের অনুমোদন পাওয়ার পর বিএসএফের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রায়ের বিষয়টি জানানো হবে ফেলানীর পরিবার রায় চ্যালেঞ্জ করতে পারবে বিএসএফের পাঁচ সদস্যের নিজস্ব আদালতের প্রধান ছিলেন বিএসএফ আধিকারিক সি পি ত্রিবেদী
রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘ফেলানী হত্যার পুনর্বিচারের রায়ে আমরা মর্মাহত ফেলানীর পরিবার যদি ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে চায় তবে বিজিবি তাদের সহায়তা করবে শুক্রবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন তিনি বলেন, বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যার রায়ের যে খবর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন তা হতাশাজনক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, রায় হলেও এটিকে চূড়ান্ত বলা ঠিক হবে না রায় বাস্তবায়নের আগে বিএসএফ প্রধানের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে আর বাহিনীপ্রধান অনুমোদন দিলেই রায় বাস্তবায়ন হবে
দেশের আইন বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, পুনর্বিচারেও ন্যায়বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার বিচার লোক দেখানো ছিল বিচার মানবাধিকারকে সমুন্নত করেনি বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এবং আইন সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রায় হতাশাব্যঞ্জক তবে রায় অপ্রত্যাশিত ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে আদালত আগে রায় দিয়েছেন সেই একই আদালত এবারও বিচার করেছেন, তাই রায় বদলাবে এমন আশা করার সুযোগ ছিল না এটা খুবই দুঃখজনক, ফেলানী ন্যায়বিচার পেল না
ব্যারিস্টার রফিকুল হক বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি তিনি বলেন, রাজনীতি আর বিচার এক জিনিস নয়
অপর আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান যুগান্তরের কাছে বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেন তিনি বলেন, রিভিউতে শুধু আইনের ভিত্তিতেই কথা বলতে হয় সেখানে ফেলানীর পক্ষে শক্তিশালী আইনজীবী ছিল না, রাষ্ট্রও কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পণ্ণ আইনজীবীর দল পাঠায়নি আর যে তদন্তে বিচার হয়েছে তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ কেননা ফেলানী গুলি খেয়ে মরেছে, তাকে কেউ না কেউ তো মেরেছে, তদন্তে সেটা উঠে আসা উচিত ছিল সুতরাং আমি মনে করি পুনঃতদন্ত করে পুনর্বিচার হলে ন্যায়বিচার হতে পারত তাছাড়া ফেলানীর পক্ষে সাক্ষীও ছিল দুর্বল আর সাক্ষীদের ভাষাগত ব্যবধানের কারণে তাদের বক্তব্য হুবহু অনুবাদ হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায় ফেলানী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, রিভিউ ছিল আইওয়াশ
অ্যাডভোকেট সালমা আলীও এলিনা খানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, বিচারের বিষয়টি ছিল লোক দেখানো এখানে স্পষ্টই মানবাধিকার শিশু অধিকার লংঘন হয়েছে ফেলানী ন্যায়বিচার পায়নি
কান্নায় ভেঙে পড়েন ফেলানীর মা-বাবা : কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী ফুলবাড়ী প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে রায়ের খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফেলানীর বাব-মা ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘অনেক আশা করেছিলাম ওই খুনি অমিয় ঘোষের এবার শাস্তি হবে কিন্তু তা হয়নি আমরা গরিব মানুষ বলে ন্যায়বিচার পেলাম না, আমার মাইয়াটারে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করল অথচ বিচারের নামে প্রহসন করে অমিয় ঘোষকে তারা খালাস দিল আসলে বিএসএফ নামে মাত্র আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছিল
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানারভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম প্রায় ১০ বছর ধরে দিল্লিতে ছিলেন সেখানে তার সঙ্গেই থাকত ফেলানী দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় ২০১১ সালের জানুয়ারি কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে বাবার সঙ্গে ফেরার পথে কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর এতে ভয়ে চিৎকার দিলে বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে লাশ নিয়ে যায়
অপ্রত্যাশিত রায়ে হতাশা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম জানান, দুই দফা সাক্ষ্য দেয়ার পরও তার মেয়ের হত্যার ন্যায়বিচার পাননি তিনি তিনি রায় প্রত্যাখ্যান করেন তার মতে, অমিয় ঘোষের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল তা না করে ভারত সরকার বিচারের নামে তামাশা করেছে তিনি বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচারের জন্য আবারও আবেদন করব
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম জানান, ‘আমার মেয়েকে যে বিএসএফ নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করল, ভারত সরকার তার বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে আমার মেয়ে তো মারা গেছে কিন্তু তার আত্মার শান্তিও পাওয়া হল না আত্মস্বীকৃত খুনি অমিয় ঘোষের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিলতিনি প্রশ্ন করেন- ‘আমরা গরিব বলে আমাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার কি কোনো অধিকার নাই?’
নিহত ফেলানীর বাড়ির প্রতিবেশীরাও রায়ের কথা শুনে হতবাক হয়েছেন প্রতিবেশী নজরুল, মজিবর, কুলসুম জানান, এমন রায়ে আমরা সবাই অবাক হয়েছি আমরা ভেবেছিলাম এর আগে যেহেতু সঠিক বিচার হয় নাই তারা বলেন, ‘বাহে হামরা এলা বুঝবার পাইলং গরিব মাইনষের বিচার আল্লাহ ছাড়া কাইও করবান নয়তাদের আশংকা সীমান্তে আরও বেশি করে বিএসএফ গুলি করে মানুষ মারবে কিন্তু বিচার হবে না
মামলায় সহায়তাকারী কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ রায় ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এর ফলে সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে বিএসএফ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে যা সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করবে রায় মানবাধিকার ন্যায়বিচারের পরিপন্থী
লিংকন জানান, ভারতীয় সরকার রায়ের বিরুদ্ধ আপিল করতে পারে পাশাপাশি ফেলানীর বাবা রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন তবে ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহায়তা প্রয়োজন
কুড়িগ্রাম বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল জাকির হোসেন ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি বলেন, এখনও অফিসিয়ালি রায়ের বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি রায়ের কপি পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে
ফেলানী হত্যা রায় ভারতীয় সংবিধান পরিপন্থী : বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, ফেলানী খাতুনের হত্যা মামলায় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণার রায়কে ভারতের আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে সে দেশেরই একটি মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংগঠন মাসুম বলেছে, বিএসএফের নিজস্ব আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তারা বেশকিছু আইনি পয়েন্ট খুঁজে বের করেছে, যেগুলো ভারতের সংবিধান আর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী
রায়কে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের প্রধান কিরিটি রায় বিবিসিকে জানান, ‘আমাদের দেশের সুপ্রিমকোর্ট নির্দিষ্ট করে বলেছে কোথাও কোনো অন্যায় অবিচার হলে যে কেউ প্রতিবাদ করে আদালতে আসতে পারে আগেকার ধারণা পাল্টে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত ফেলানীর পরিবারের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছেতবে মাসুম বলছে, এর আগেও তারা একবার ভারতীয় আদালতে ফেলানী হত্যা নিয়ে মামলা করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তখন ফেলানীর পরিবারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নথি আর সহযোগিতা তারা পাননি নতুন করে বিএসএফের রায়কে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বেশ কিছু আইনি পয়েন্টও তারা খুঁজে বের করেছেন বলে জানান কিরিটি রায় তাদের প্রশ্ন, ‘এটা কে ঠিক করল যে শুধুমাত্র অমিয় ঘোষই অভিযুক্ত? যেখানে ফেলানী মারা যায়, সেখান দিয়ে এর আগে আরও চল্লিশজন বেড়া পেরিয়েছে, বিএসএফ-বিজিবি টাকা নিয়েছে সবার কাছ থেকে এটা ওয়েল রেকর্ডেড তাই যারা সেই বেআইনি কাজের অনুমতি দিল ঘোষের সহকর্মী বা সিনিয়র অফিসাররা তারা কেন দোষী হবেন না?’
কিরিটি রায় আরও জানান, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেকের জীবনের অধিকার রয়েছে শুধু ভারতের নাগরিক নয়, দেশের মাটিতে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির এক্ষেত্রে সেটাও লংঘিত হয়েছে
যা ঘটেছিল : ২০১১ সালের জানুয়ারি ভোরে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে ফেরার সময় ভারতের চৌধুরীহাট বিএসএফ ক্যাম্পের অমিয় ঘোষ ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে সীমান্তে মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরোনোর সময় বিএসএফের ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের হাবিলদার অমিয় ঘোষ খুব কাছ থেকে তার ইনসাস .৫৬ মিলিমিটার বন্দুক থেকে গুলি করেন বুকে গুলি লাগায় ফেলানীর মৃত্যু হয় এরপর কাঁটাতারের ওপর ফেলানীর লাশ কয়েক ঘণ্টা ঝুলে ছিল কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পক্ষ থেকেও বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে ফেলানী হত্যার বিচারের জন্য চাপ দেয়া হয় এর দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট কোচবিহার জেলার সোনারি এলাকায় ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন সদরদফতরে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয় ওই বিচারে বিএসএফ সদস্যকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেয়া হয় রায় প্রত্যাখ্যান করে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি ক্ষতিপূরণ দাবি করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে আবেদন করেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু এরই পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ বাবা নুরুল ইসলাম গত বছরের ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষ্য দেন ভারতের ওই বিশেষ আদালতে কয়েকদিন আদালত চলার পর ২০ নভেম্বর আদালত মুলতবি হয়ে যায় ২৫ মার্চ পুনরায় বিচার কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন আদালত ২৬ মার্চ আইনজীবীর অসুস্থতার কারণে আদালত আবারও ২৯ জুন পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায় পরে ৩০ জুন আদালত শুরু হয়ে দিন চলে এরপরই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রায় ঘোষণা করা হয়

Comments

Social Share Icons

Popular Posts

শীঘ্রই বাংলাদেশও আমাদের হবেঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে নিউজটি ভুয়া ছিল স্বীকার করতে বাধ্য হলো ডেইলি স্টার

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে” - তরিকুল ইসলাম (সাবেক মন্ত্রী)