কল্যাণের জন্য পরিবর্তন, পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি-মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
ঢাকা, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪
amarbanglanews24আজকের কলামটি লিখেছি একটি ছোট কথা মনের মধ্যে রেখে। কথাটি হলোÑ আগামীকাল বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্মদিবস বা প্রতিষ্ঠাবার্ষির্কী। এই দিবসটিকে সামনে রেখে পাঠকসমাজের কাছে এমন দু’চারটি কথা তুলে ধরতে চাই, যেগুলো নিয়ে তারা চিন্তা করতে পারেন। আমি সময় পেলে অন্যান্য বাংলা পত্রিকার জন্যও লিখি। যার অন্যতম জনপ্রিয় দু’টি পত্রিকা যুগান্তর ও কালের কণ্ঠ। তবে সপ্তাহের কোনো নির্ধারিত দিনে নয়। আমার সুবিধা মতো সময়ে লিখি এবং পত্রিকা কর্র্তৃপ তাদের সুবিধামতো সময়ে প্রকাশ করেন। পত্রিকায় কলাম লিখি প্রায় সতেরো বছর ধরে। তিনটি কলাম-সঙ্কলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে গত ১০ বছরে এবং চতুর্থ সঙ্কলনটি প্রকাশ হওয়ার পথে। এই দীর্ঘ এক-দেড় যুগ সময়ে প্রচুর কলামে আমি বাংলাদেশকে নিয়ে আমার চিন্তাচেতনা, বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে আমার আগামী দিনের চিন্তাচেতনা ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের অনুকরণীয় নেতৃত্ব প্রসঙ্গে লিখেছি।    অনুকরণ ও অনুসরণীয় নেতৃত্ব ১৯৬৮-৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অনার্স পড়ার সময়, প্রতিটি ১০০ নম্বরের আটটি বিষয় ছিল। যতটুকু মনে পড়ে, একটি বিষয়ের নাম ছিল কমপারেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমি বা ওই ধরনের কিছু। ওই বিষয়ের আওতায় জাপান ও কোরিয়াসহ মোট চারটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল। এখন রাজনীতিতে এসে শুধু উন্নয়নপ্রক্রিয়া নয়, রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব প্রসঙ্গেও আমি তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে বাধ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কাছে আমার নেতারা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অথবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম অতি শ্রদ্ধেয়। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিগত কারণে তাদের মেয়াদ ছিল অতি সংপ্তি। তাই এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি ব্রিটিশ (মহিলা) প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার অথবা ইসরাইলের (মহিলা) প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার অথবা ভারতীয় (মহিলা) প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অথবা এই মুহূর্তে শক্তিশালী দেশ জার্মানির (মহিলা) প্রধানমন্ত্রী এঞ্জেলা মার্কেলের কথা বলতে পারি। বিশ্ববিখ্যাত দণি আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা অথবা ইরানের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদি নেজাদের কথা বলতে পারি। তুরস্কের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের কথাও বলা যেতে পারে। কিন্তু ওইসব বাদ দিয়ে, আমি এই কলামের সম্মানিত পাঠকসমাজের কাছে সুপরিচিত দু’টি দেশের নেতার কথা উল্লেখ করা শ্রেয় মনে করি। একটি দেশ হলো সিঙ্গাপুর। ১৯৬৫ সালে বাধ্য হয়েই মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা নিয়েছিল নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ১৮ বছর একনাগাড়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লি কুয়ান ইউ। সিঙ্গাপুর নামে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে উন্নত প্রথম বিশ্বের দেশে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। আরেকটি দেশের নাম মালয়েশিয়া। একনাগাড়ে বাইশ বছর মালয়েশিয়ার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ডাক্তার মাহাথির মুহাম্মদ। তারা উভয়েই আত্মজীবনী লিখেছেন। মাহাথিরের লেখা দীর্ঘ বইটির নাম এ ডক্টর ইন দ্য হাউজ। নামটির বাংলা অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘বাড়িতে একজন চিকিৎসক’।  আমাদের দেশে বা সমাজে এখন যেরকম চতুর্দিকে হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদির ছড়াছড়ি, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে এরকমটি ছিল না। অসুস্থ হলে, পারিবারিকভাবে পরিচিত বা এলাকায় সবার কাছে পরিচিত এমন ডাক্তারের কাছে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হতো অথবা এমন ডাক্তারকে খবর দিলে তিনি এসে রোগী দেখে যেতেন। বেশির ভাগ েেত্রই রোগীরা নিজ নিজ ডাক্তারের ভক্ত হতেন এবং ডাক্তাররাও রোগীদের পরিবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সব কিছু বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা দিতেন। একই রকম অবস্থা অন্যান্য অনুন্নত এশিয়ান দেশেও ছিল। তরুণ বয়সে আইনজীবী হতে চাইলেও পরিস্থিতির কারণে মাহাথির চিকিৎসক হয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তিনি শুধু রোগী দেখেননি, চিকিৎসকের অভিজ্ঞতায় রাজনীতিকেও দেখেছেন। নিজের লেখা বইয়ের মধ্যেই মাহাথির মুহাম্মদ ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, পঞ্চাশের দশকে বা ষাটের দশকে বা সত্তরের দশকেও মালয়েশিয়া নামে দেশ ও সমাজকে একটি রোগী বিবেচনা করলে, তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। ওই ডাক্তার রাজনৈতিক ডাক্তার। মাহাথির মুহাম্মদ নামে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ওই রাজনৈতিক ডাক্তারের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই তিনি তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন ‘বাড়িতে একজন চিকিৎসক’।    বাংলাদেশের সুস্থতা ও অসুস্থতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুস্থতা নিরাময়ের জন্যও চিকিৎসক প্রয়োজন। বাংলাদেশ কি রাজনৈতিকভাবে বা সামাজিকভাবে অসুস্থ? আমার মতে উত্তর হলো, অসুস্থ না বললেও অবশ্যই বলতে হবে যে, পুরোপুরি সুস্থ নয়। সুস্থতায় ঘাটতি কতটুকু অথবা অপর ভাষায় কতটুকু অসুস্থ তার উত্তর একেকজন চিন্তাশীল ব্যক্তি বা বিশ্লেষক একেক নিয়মে দেবেন। উত্তরটি পাঁচ পৃষ্ঠার রচনা থেকে নিয়ে ৫০০ পৃষ্ঠার বই করেও দেয়া যাবে। পাঁচ পৃষ্ঠার থেকেও ছোট হলো তিন হাজার শব্দের একটি কলাম। এরকম একটি কলাম লিখেছেন একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, নাম পীর হাবিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী পরিচালক। আমি বাংলাদেশের অসুস্থতা প্রসঙ্গে উত্তর নিজের ভাষায় না দিয়ে, পীর হাবিবুর রহমানের ভাষায় দিচ্ছি। মঙ্গলবার ২৫ নভেম্বর ২০১৪, তিনি তার নিজের পত্রিকায় যেই কলামটি লিখেছিলেন সেই কলামটির কিছু অংশ এখানে হুবহু উদ্ধৃত করছি। ... ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মতো কঠিন এবং রাজনীতির মতো দুর্বোধ্য বিষয় মোকাবিলা করেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ছোটখাটো বিষয়ের সমস্যা সমাধানেও যখন ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, তখন নেতৃত্বের সংকট উন্মোচিত হয়। দেশে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা ও সম্মানের জায়গা সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। ছাত্র রাজনীতি মেধাবী সৃজনশীল ছাত্রদের কাছ থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে ছাত্র সমাজের আস্থা হারিয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্য বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ স্বীকৃত হয়েছে। দুর্নীতি দিনে দিনে বহু বেড়েছে। রাজনীতিতে সহনশীলতার উল্টোপথে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে প্রতিহিংসা। গুম, খুন মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করেছে। ইয়াবাসহ মাদকের আগ্রাসন একেকটি পরিবারকেই নয় দেশের একটি প্রজন্মকে অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সম্পদ সীমিত, জনসংখ্যা বাড়ছে। শিল্প, কল-কারখানা থেকে ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। শিতি বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মসংস্থানের খবর নেই। উন্নয়ন চলছে, দুর্নীতি থেমে নেই। রাজনীতিতে ত্যাগবাদী আদর্শের উল্টোপথে উন্নাসিক রূপ নিয়েছে ভোগ-বিলাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তদবির বাণিজ্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মানুষের লোভ-লালসা এতটাই তীব্র যে, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বাজিকরদের আস্ফালন চলছে। গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন যেমন চলছে তেমনই আন্দোলনের নামে দেখা দেয় মানুষ হত্যা আর জানমালের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। সাংবিধানিকভাবে জনগণ মতার মালিক হলেও রাজনৈতিক শক্তির কাছে মানুষের অধিকার ও সম্মানবোধ দিনে দিনে পদদলিত হচ্ছে...।’ এরূপ পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘ দিনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অতএব এরূপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণও এক দিনে পাওয়া যাবে না।    যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও ওইগুলোর প্রভাব পরিত্রাণ পেতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যেকোনো কাজ করতে গেলে শুধু শ্রম দিয়েও হয় না। মেধা, শ্রম, সময় এবং অর্থ এ সব কিছুর সমন্বিত বিনিয়োগেই একটা ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু সব কিছুর আগে প্রয়োজন একটি সিদ্ধান্ত। ইতিহাসের একেকজন মহানায়ক, তার পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেেিত একেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; সিদ্ধান্তগুলো যুগান্তকারী ছিল। জন্মস্থান মক্কা নগরী থেকে বাধ্য হয়ে হিজরত করেছিলেন তথা দেশান্তরী হয়েছিলেন বিশ্বনবী তথা মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা:। ৯ বছর পর তিনি যখন মদিনা থেকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে মক্কা নগরী বিজয় করেছিলেন, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, ইসলামবিদ্বেষী ও ইসলামবিরোধী মক্কাবাসীর সাথে তিনি কী রকম আচরণ করবেন। ২৭ বছর জেলে বন্দী থাকার পর, নেলসন ম্যান্ডেলা যখন মুক্ত হন এবং নেতৃত্ব নেন তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তিনি কী নিয়মে দেশ পরিচালনা করবেন, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো চামড়ার মানুষদের ওপর দীর্ঘ দিন অত্যাচার করা সংখ্যালঘিষ্ঠ সাদা চামড়ার মানুষদের সঙ্গে কী রকম আচার-আচরণ হবেÑ এই প্রসঙ্গে। ইস্ট তিমুর বা পূর্ব তিমুরের গেরিলা নেতা জানানান গুজমাও, ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য প্রায় এক দশক স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতা পাওয়ামাত্র তাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল অনেক ব্যাপারে, বিশেষত ইন্দোনেশিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কেমন হবে সেই প্রসঙ্গে। দীর্ঘ দিন সংগ্রামের পর, ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন ভিয়েতনামের জনগণ। কিছু দিনের মধ্যেই উত্তর এবং দণি ভিয়েতনাম পৃথক হয়ে যায়। দণি ভিয়েতনাম মার্কিনপন্থী এবং উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট চীনপন্থী। আমেরিকার বিরুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় যুদ্ধ করে ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম আরিক অর্থেই দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়। ভিয়েতনামকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কী রকম সম্পর্ক রাখবে এবং চীনের সাথে কী রকম সম্পর্ক রাখবে। বর্তমানে যা বাংলাদেশ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সেটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তারা নিকটতম প্রতিবেশী, একটু দূরের প্রতিবেশী, অনেক দূরের প্রতিবেশী এরূপ রাষ্ট্রগুলোর সাথে কী রকম সম্পর্ক রাখবে এবং বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা কী রকম হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক বছরগুলোতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবান্বিত করছে। স্থানের অভাবে সিদ্ধান্তগুলো আজ এখানে আলোচনা করছি না; অন্য দিন করব। নিট ফল, আজ ২০১৪ সালে এসে সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেশটি ভদ্রবেশী দুর্বৃত্তের দখলে, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিবেশী দেশের কলোনি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিস্ফোরণের অপোয় থাকা একটি আগ্নেয়গিরির মতো। অমিত সম্ভাবনার দেশ, বাংলাদেশ। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতায় অথবা নেতৃত্বের ইচ্ছাকৃত অবহেলায় এবং অন্যান্য কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে আছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে উন্নতি অবশ্যই অনেক হয়েছে, কিন্তু আমাদেরই মতো পরিস্থিতিতে থাকা অন্যান্য দেশের তুলনায় সেটা কম। অপর ভাষায় বলা যায় যে, যতটুকু উন্নতি করতে পারতাম, ততটুকু হয়নি। আমাদের সাফল্য যা কিছু আছে তার জন্য কৃতিত্ব যেমন আমাদের, তেমনি ব্যর্থতাগুলোর জন্য দায়িত্বও আমাদের। এরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। অতীতের ভুল সংশোধন প্রয়োজন। একটি দেশ যেহেতু রাজনীতিবিদেরা পরিচালনা করেন তাই, রাজনীতিতেই চিকিৎসা প্রয়োজন। এটুকু সিদ্ধান্তের পরিপ্রেেিতই রাজনীতি করছি।    রাজনীতিতে কয়েকজন সামরিক ব্যক্তির কথা কোরিয়ার পার্ক চুং হিং-এর কথা। বর্তমান বিশ্বে বিশেষত এশিয়ায়, একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ উন্নত দেশ হচ্ছে দণি কোরিয়া। দণি কোরিয়ার ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন পার্ক চুং হি। মেজর জেনারেল পার্ক চুং হি একটি সামরিক ক্যু-দেতার মাধ্যমে মতা গ্রহণ করে দুই বছর সামরিক শাসক হিসেবে দেশ শাসন করেছিলেন, অতঃপর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসন করেছিলেন পরবর্তী প্রায় চৌদ্দ বছর। আধুনিক কোরিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি তার আমলেই রচিত হয়। আমেরিকার আইজেনহাওয়ারের কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার রণাঙ্গনের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন চার তারকা জেনারেল ডুআইট ডি আইজেনহাওয়ার। ১৯১৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চাকরি করার পর তিনি অবসরে যান। অতঃপর প্রায় সাথে সাথেই রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন আইজেনহাওয়ার। আমেরিকার কেনেডির কথা। প্রায় এক দশক সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর, ১৯৬০-এর নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জন এফ কেনেডি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর ১৯৪০ সালে জন এফ কেনেডি মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরের রণাঙ্গনে, অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে তিনি সামরিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে ২৯ বছর বয়সে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার ইউধোয়োনোর কথা। এখন (ডিসেম্বর ২০১৪) থেকে কয়েক মাস আগে মাত্র ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবসরে গিয়েছেন (জেনারেল) সুসিলো বামবাং ইউধোয়োনো। সব রকমের মূল্যায়নেই তিনি একজন সফল প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রায় তিন দশকের আলোচিত-সমালোচিত ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল সুহার্তোর শাসনের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীতে সংস্কারপন্থীদের আবির্ভাব ঘটেছিল। সংস্কারপন্থীদের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুসিলো বামবাং ইউধোয়োনো। পরবর্তী সাত আট বছরে একটু একটু করে তিনি জাতীয় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। উপযুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। ফ্রান্সের দ্যা’গল-এর কথা। ফ্রান্সের অতি বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক চার্লস দ্যা’গল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্স দখলকারী জার্মানির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যমপর্যায়ের র‌্যাংকের অফিসার ছিলেন; যুদ্ধ-পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আরো পরে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের কথা। বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রপতি ছিলেন শহীদ জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে নিয়মিত চাকরি করেন, মাঝখানে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ। পরিস্থিতি তাকে রাজনীতিতে টেনে আনে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ভারতের ভি কে সিং-এর কথা। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনী হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ৩১ মে ২০১২ তারিখে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন জেনারেল ভি কে সিং। ২০১৪ সালের ভারতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজেপির হয়ে সফল লোকসভা নির্বাচন করেন। সরকার গঠনের পর তাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। যাদের নাম এতণ আলোচনা করলাম তারা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে, অল্প দিন হোক বেশি দিন হোক। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এমন ব্যক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচুর আছে। আমি শুধু হাতেগোনা কয়েকজন যারা উচ্চতম পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন তালিকা থেকে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশেও বিএনপি বা আওয়ামী লীগ উভয় দলেই অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তি আছেন, অনেকেই মন্ত্রী হয়েছেন, বহু অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছেন। আমিও ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছি মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায়, সম্মান ও সন্তুষ্টির সঙ্গে, মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে অংশগ্রহণসহ। আমার এলপিআর বা প্রাক-অবসর ছুটি শেষ হয় জুন ১৯৯৭ সালে। দশ বছর গ্যাপের পর ২০০৭ সালে প্রত্যভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। পার্থক্য হলো, আমি একটি দল প্রতিষ্ঠা করে সেই দলের কর্মী হিসেবে রাজনীতির মাঠে সংগ্রামী জীবন শুরু করেছি, ৫৮ বা ৫৯ বছর বয়সে। যখন আরাম-আয়েশের দিকে বা বিশ্রামের দিকে মনোযোগ দেয়াটাই স্বাভাবিক, তখন কষ্ট বেছে নিয়েছি।    পরিবর্তন আহ্বান বিদেশে ও বাংলাদেশে ২০০৭-০৮ সালে বারাক ওবামা এবং ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা উভয়েই পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বা পরিবর্তনের কথা প্রচার করে পরিবর্তন কায়েম করার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের দল ছিল, তাদের রাজনৈতিক দলগত কাঠামো ছিল, তাদের দলের আর্থিক শক্তি ছিল, তাদের দলের প্রতি শুভাকাক্সী মিডিয়া ছিল এবং তাদের দলের শুভাকাক্সীদের মেধা-শক্তি ছিল। সব কিছু ব্যবহার করেই যথাক্রমে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট এবং শেখ হাসিনা পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে অনেক চিন্তাশীল সচেতন নাগরিক মিলে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে, পরিবর্তনের প্রচারণার সূচনা করেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করেছিল। জন্মদিবস থেকেই এদের নীতিবাক্য (বা ইংরেজি ভাষায় ‘মটো’) ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বা ‘পলিটিক্স ফর চেইঞ্জ’। পরিবর্তন অনেক আঙ্গিকেই কাম্য ছিল এবং এখনো কাম্য আছে। প্রথম এবং প্রধানতম কামনা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু বারাক ওবামার দলের মতো বা শেখ হাসিনার দলের মতো এই নতুন দলটির ঐতিহ্য ছিল না, মেধাশক্তি সীমিত ছিল, অর্থশক্তি অতি নগণ্য ছিল। এই নতুন দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৩৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন ও বিদ্যমান প্রথা ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিকল্প হিসেবে পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি স্লোগান নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। নির্বাচনে জিততে পারিনি তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তনের জন্য মনের আকাক্সা স্থগিত হয়েছে। আকাক্সা এখনো জাগ্রত এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত। তবে কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি কিঞ্চিত পরিবর্তিত হয়েছে।    পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশে বিদ্যমান বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকেই এই গুণগত পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা চাই সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে জড়িত হোক। আমরা চাই সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণের খেদমতের সুযোগ পাক। আমরা চাই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন হোক যেখানে সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন, জনগণের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে পারেন। যথেষ্ট বা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তি যদি পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন তাহলে পার্লামেন্ট সদস্যগণের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। সে জন্য বাংলাদেশে সাহসী ভোটার প্রয়োজন, যে ভোটারেরা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। সে জন্য বাংলাদেশে সাহসী মিডিয়া প্রয়োজন, যে মিডিয়া সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে এবং প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাক্সিত গুণগত পরিবর্তনের আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নি¤œরূপ। প্রথম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয়, ধর্মীয় নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের নেতারা এবং জাতীয় নেতারা জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবে, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবে না। তৃতীয়, সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। চতুর্থ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হবে। পঞ্চম, প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়নের এবং অবদানের কাঠামো। ষষ্ঠ, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সততা এবং প্রযোগিতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সপ্তম, রাজনীতি ও ব্যবসায় তারুণ্যকে তথা বাংলাদেশের তরুণসমাজকে উৎসাহিত করতে হবে অগ্রাধিকার দিয়ে। অষ্টম এবং শেষ, বাংলাদেশের মঙ্গল, বাংলাদেশের কল্যাণ, বাংলাদেশের নাগরিকগণের উপকার কোন কোন পন্থায় এবং কিসে কিসে নিহিত এই প্রসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে।    উপসংহার ও দোয়া প্রার্থনা এই মুহূর্তে আমরা দু’টি রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত। একটি সংগ্রাম অতি সহজেই দেখা যাচ্ছে, আরেকটি সংগ্রাম অত সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনেক সহজে অনুভব হচ্ছে না। সহজেই দেখা যাচ্ছে এমন সংগ্রামটি হচ্ছে, সঠিক গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করার জন্য তথা সর্বদলীয় অংশগ্রহণে নিরপে তত্ত্বাবধানে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনুভূত হচ্ছে না এমন সংগ্রাম হচ্ছে, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার সংগ্রাম। নয়া দিগন্তের পাঠকেরা তাদের মনের চুকে প্রসারিত করে অনুভব করার চেষ্টা করবেন বলে আমরা আশা রাখি। আজ কলাম পড়ার পর, আগামীকাল ৪ ডিসেম্বর-এর জন্য পাঠককুলের শুভেচ্ছা তথা দোয়া কামনা করি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি  
www.generalibrahim.com

Comments

Social Share Icons

Popular Posts

শীঘ্রই বাংলাদেশও আমাদের হবেঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ

বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে নিউজটি ভুয়া ছিল স্বীকার করতে বাধ্য হলো ডেইলি স্টার

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ বড় বেশি মনে পড়ে” - তরিকুল ইসলাম (সাবেক মন্ত্রী)